| |
               

মূল পাতা বিশেষ প্রতিবেদন আফগানদের বীরত্বের প্রতীক বাগরাম বিমানঘাঁটি; আমেরিকা কি পারবে ফের দখলে নিতে?


আফগানদের বীরত্বের প্রতীক বাগরাম বিমানঘাঁটি; আমেরিকা কি পারবে ফের দখলে নিতে?


শেখ আশরাফুল ইসলাম     01 October, 2025     10:43 AM    


ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের কাবুলের উত্তরে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকান বাহিনীকে পরাজিত করার এক ঐতিহাসিক প্রতীক। এই বিমানঘাঁটি প্রমাণ করে আফগানরা বীরের জাতি। তারা কখনো কারো দাসত্ব মেনে নেয়নি, এই বিষয়টিরও জলজ্যান্ত প্রমাণ বাগরাম বিমানঘাঁটি।

এবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও দখল করতে চাইছেন এই বিমানঘাঁটি। তবে সেটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি কঠিন।

ট্রাম্প এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিশ্বের অন্যতম বড় বিমানঘাঁটি আমরা তাদের (আফগানদের) বিনা মূল্যে দিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা সেটি ফেরত চাই। চীনের পারমাণবিক স্থাপনার এক ঘণ্টার দূরত্বে এই ঘাঁটি।”

পরে ট্রাম্প নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে লিখেন: “যদি আফগানিস্তান বাগরাম ঘাঁটি ফিরিয়ে না দেয়, তবে খারাপ কিছু ঘটবে!”

শুধু কথার ঝড় নয়, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, আমেরিকা নীরবে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে বাগরামে আবার প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য। এ যেন এক অদ্ভুত মোড়; যে ঘাঁটি ২০২১ সালে আমেরিকা হুড়োহুড়ি করে ছেড়ে গিয়েছিল, সেটাই আবার ফেরত চাইছে।

বাগরামের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস :

বাগরাম কেবল এক টুকরো জমি নয়; এটি মহাশক্তিধরদের সাথে আফগানিস্তানের দ্বন্দ্বের প্রতীক।  ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েতরা এটি নির্মাণে সাহায্য করে। এমনকি ১৯৫৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের বিমানও এখানে অবতরণ করেছিল। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সোভিয়েত সেনাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল এটি। এখান থেকেই তারা সারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করত।

সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর আফগান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পরে তালেবান এটি দখল করে।  ২০০১ সালে আমেরিকা তালেবানকে সরিয়ে দিয়ে ঘাঁটিটি দখল নেয়। এরপর দুই দশক ধরে এটি মার্কিন সেনাদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিল। এখানে ১০ হাজার সেনা থাকত, আর ঘাঁটিটি ৭৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত।

কিন্তু ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানের আক্রমণে বাধ্য হয়ে আমেরিকা রাতারাতি ঘাঁটি ছেড়ে চলে যায়। তালেবানের কাছে এটি আমেরিকার চূড়ান্ত পরাজয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।

তালেবানের নেতৃত্বাধীন আফগান সরকারের প্রতিক্রিয়া :

ট্রাম্পের বক্তব্যে কাবুল দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জাকির জালালি বলেন, “আফগানরা কখনো বিদেশি সেনা উপস্থিতি মেনে নেয়নি। দোহা চুক্তিতেও বিষয়টি একেবারেই বাতিল করা হয়েছে।”

অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “আমরা কখনো বাগরাম কাউকে দেব না। এসব দাবি ভিত্তিহীন।”

তালেবানের গোয়েন্দা বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইসলামী শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনে আবারও আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নেবে তারা।

যে কারণে ভূরাজনীতিতে বাগরাম গুরুত্বপূর্ণ :

বাগরাম থেকে কাবুল, পাকিস্তান, ইরান, চীন এমনকি রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলও সহজেই নজরদারিতে রাখা যায়। এজন্যই মার্কিন প্রেসিডেন্টের নজর ফের এদিকে।

ট্রাম্পের যুক্তি হলো, ঘাঁটিটি চীনের পারমাণবিক স্থাপনার কাছে। কিন্তু চীন বলেছে, “আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ আফগান জনগণের হাতে থাকবে। উত্তেজনা ছড়ানো আমরা সমর্থন করি না।”

বিশ্লেষকদের মতে, চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসার বিরুদ্ধে। এমনকি যদি তালেবান রাজি হয়ও, চীন তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে—খনির চুক্তি বাতিল, বাণিজ্য বন্ধ, কিংবা রাজনৈতিক স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে।

আমেরিকা কি পারবে বাগরাম বিমানঘাঁটি দখল করতে?

এই ঘাঁটি দখল করা আমেরিকার জন্য প্রায় অসম্ভব বলা যায়। আমেরিকাকে নতুন করে অন্তত ১০ হাজার সেনা পাঠাতে হবে, উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে বিষয়টি আসলে নতুন এক দখলদারি যুদ্ধের মতো দেখাবে।

এর ওপর আছে আরও ঝুঁকি—আল-কায়েদা, আইএস, এমনকি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কা।

তাহলে ট্রাম্পের লক্ষ্য কী?

ট্রাম্প আসলে বাগরামকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ফেরানোর চেয়ে এটিকে রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত করতে চাইছেন।

তবে আফগানদের কাছে এটি বিদেশি শক্তি তাড়ানোর প্রতীক। আমেরিকানদের কাছে এটি ২০২১ সালের পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি। আর ট্রাম্পের কাছে এটি “হারানো সম্মান” ফেরত পাওয়ার সুযোগ এবং চীনের বিরুদ্ধে চাপ তৈরির হাতিয়ার।

এজন্যই বাগরাম বিমানঘাঁটি নিয়ে সমীকরণটা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। 

বাস্তবে বাগরাম ইতিমধ্যেই দুটি পরাশক্তির সমাধিক্ষেত্র হয়েছে; সোভিয়েত আর আমেরিকা। দু’জনই এসেছে, ঘাঁটি বানিয়েছে, শেষে অপমানিত হয়ে চলে গেছে।